ক্যান্সারের ঝুঁকিতে মোবাইল ফোন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। জাতিসংঘের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক সংস্থা আইটিইউ এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা পেরিয়ে গেছে ৫০০ কোটি। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মোবাইল ফোন থেকে ক্যান্সার হাবর
ঝুঁকি রয়েছে। এই সংক্রান্ত তথ্য আলোচনা নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত প্রযুক্তি পণ্যের নাম মোবাইল ফোন। পৃথিবীর সব দেশেই সব শ্রেণী পেশার মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে এই মোবাইল ফোনের সেবা। মোবাইল ফোন ছাড়া আসলে আমরা আর একটি দিনও অতিবাহিত করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। তবে মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সাথে নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি নিয়েও গবেষণা চলে আসছে অনেক দিন থেকেই। সব ধরনের মোবাইল থেকেই তড়িত্ চোম্বকীয় বিকিরণ (ইলেকট্রো-ম্যাগটিক রেডিয়েশন) ঘটে যা মানব শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, মোবাইল ফোনের এই বিকিরণ দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সারের মতো রোগ তৈরি করতে পারে। শুধু প্রযুক্তি বিশ্ব- নয়, গোটা বিশ্বেই এই গবেষণা নিয়ে চলছে তোলপাড়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন
জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউ এইচ ) এর অধীনে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যে সমস্ত রোগ মানবজাতির জন্য অনেক বেশি হুমকি তাদের নিয়ে গবেষণার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা গবেষণা সংস্থা। অন্যতম মরণব্যাধি ক্যান্সার নিয়ে গবেষণায় ঠিক এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এই সংস্থাটি ক্যান্সারের বিভিন্ন কারণ নিয়ে গবেষণা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত নানা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা পৃথিবীর ১৪টি দেশের ৩১ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে বসেন। সব ধরনের তথ্য এবং প্রমাণ বিশ্লেষণ শেষে তারা জানান, মোবাইল ফোনের তড়িত্ চৌম্বকীয় বিকিরণ থেকে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা মোবাইল ফোনকেগ্রুপ ২বিতে রেখেছেন। এর অর্থ হচ্ছে সম্ভবত মোবাইল ফোন মানব শরীরে ক্যান্সারের একটি কারণ
প্রতিবেদনের এই সিদ্ধান্তের অর্থ হচ্ছে মানব শরীরে ক্যান্সারের সাথে মোবাইল ফোনের তড়িত্ চৌম্বকীয় বিকিরণের কিছু সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ এতো পর্যাপ্ত এবং শক্তিশালী নয় যে, সরাসরি মোবাইল ফোনকেই ক্যান্সারের কারণ হিসেবে অভিহিত করা যায়। নির্দিষ্ট করে বললে, আইএআরসি গবেষকরা দুইটি নির্দিষ্ট ধরনের মস্তিষ্কের টিউমারের সাথে মোবাইল ফোনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। এই দুইটি টিউমার হচ্ছে গ্লিওমা এবং অ্যাকোস্টিক নিউরোমা। এই দুই ধরনের ব্রেইন টিউমার পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। আর এই দুই ধরনের ব্রেইন টিউমার ঘটাতে ভূমিকা রাখতে পারে মেবাইল ফোনের বিকিরণ। আইএআরসি এই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান . জোনাথান সামেট এই ফলাফল সম্পর্কে বলেন, ‘এই গবেষণা থেকে যে সিদ্ধানেত উপনীত হওয়া যায় তা হচ্ছে, মোবাইল ফোন থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। নূন্যতম মাত্রায় এই ঝুঁকি হলেও একে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। আর তাই মোবাইল ফোনের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে আরও দীর্ঘদিনের গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। খুব নিবিড়ভাবে এই সম্পর্কটি আমাদের পর্যবেক্ষন করতে হবে
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মোবাইল ফোন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আইএআরসি কর্তৃক ক্যান্সার জনক বা ক্যান্সারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন খাদ্য বা পণ্যের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। মোবাইল ফোনের তড়িত্ চৌম্বকীয় গবেষণার পর মোবাইল ফোনকেও এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে খাদ্য বা পণ্য তালিকাভূক্ত করা হয়েছে তালিকার প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে ধুমাপন, অ্যাসবেস্টস, অ্যালকোহলের মতো সব দ্রব্যাদি যেগুলো সরাসরি ক্যান্সার তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই তালিকারগ্রুপ ২বিতে স্থান দেয়া হয়েছে মোবাইল ফোনকে। এই গ্রুপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত দ্রবাদি মানুষের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এসব পণ্যের ক্যান্সার তৈরিতে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ পর্যাপ্ত নয়। এর অর্থ হচ্ছে, এই ঝুঁকির পেছনে কিছু প্রমাণ রয়েছে, তবে তা সরাসরি ক্যান্সারের জন্য দায়ী করার মতো পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়
মোবাইল ফোনের বিকিরণ
সব ধরনের মোবাইল ফোনেই তড়িত্ চৌম্বকীয় বিকিরণ ব্যবহূত হয়। এই বিকিরণগুলো হয়ে থাকে মাইক্রোওয়েভ ধরনের। এগুলোকে বলা হয়নন-আয়নাইজং রেডিয়েশন এই বিকিরণ এক্সরের বিকিরণের মতো নয়, বরং কম ক্ষমতার মাইক্রোওয়েভ ওভেনের বিকিরণের মতন। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত বিকিরণের একটি অংশ শোষিত হয় মানব মস্তিষ্কে। সাধারণত জিএসএম হ্যান্ডসেটগুলোর সর্বোচ্চ বেতার তরঙ্গের ক্ষমতা ওয়াাট। সিডিএমএ সেটগুলোর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ গড়ে ওয়াট। মোবাইলের এই বিকিরণের একটি প্রভাব হচ্ছে তাপীয়। এর মাধ্যমে যেকোনো ডাই ইলেকট্রিক বস্তু (যেমন, জীবন্ত মানব টিস্যু) উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় সেটটি সাধারণত কানের নিকটবর্তী মস্তিষ্কের অংশের সাথে সংযুক্ত থাকে। মস্তিষ্কের সেই অংশের কোষ বা টিস্যুগুলোর উপর তখন এই বিকিরণের প্রভাব পড়ে
এই প্রভাব সম্পর্কে লস অ্যাঞ্জেলস এর সিডারস সিনাই মেডিকেল সেন্টারের নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান . কেইথ ব্ল্যাক বলেন, ‘মাইক্রোওয়েভ ওভেনে যেমনটি ঘটে থাকে, মোবাইলের বিকিরণেও আমাদের মস্তিষ্কে ঠিক একই রকম প্রভাব পড়ে। তাই ক্যান্সার বা টিউমারের ঝুঁকি ছাড়াও স্মরণশক্তিতে এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। কেননা, যেখানে আমরা মোবাইল ধরে রাখি, মেমোরি টেমেপোরাল লোব ঠিক সেই স্থানেই অবস্থিত তিনি আরো জানান, ‘পরিবেশের এসব নানান উপাদানের প্রভাব ঠিক অল্প সময়ে বোঝা যায় না। অনেক বিষয়ের সঠিক ফলাফল পেতে কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়। বিষয়টিও ঠিক তেমনই
আরো গবেষণা প্রয়োজন
মোবাইলের বিকিরণ নিয়ে গবেষণা এই প্রথম নয়। বরং গত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানী, গবেষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চলে আসছে গবেষণা। ২০১০ সালের এরকম একটি গবেষণাতেও দেখানো হয়- যারা ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে ব্রেইন গ্লিওমায় আক্রান্ত হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। অন্যান্য গবেষণাতেও প্রায় একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়। এগুলোর কোনোটিতেই ক্যান্সারের কারণ হিসেবে মোবাইলের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা না থাকলেও সতর্কতার বিষয়টিতে জোর দেয়া হয়েছে। ঠিক এমনই একজন গবেষক . হেনরি লাই। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর এই গবেষক অধ্যাপক ৩০ বছর ধরে তড়িত্ চৌম্বকীয় বিকিরণের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তিনি জানান, ‘ক্যান্সার, বিশেষত ব্রেইন ক্যান্সারের সূচনা থেকে পূর্ণাঙ্গতা পাওয়া একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। আর মোবাইল ফোনের বিকিরণের সাথে এর সম্পর্ক নির্ণয়েও আরও সময় প্রয়োজন। তবে সেই সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গভাবে নিরুপিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সকলের জন্য সতর্কবাণী প্রদান করা উচিত
প্রযুক্তি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিবেদনে প্রযুক্তি বিশ্ব সাড়া দিয়েছে মিশ্র ভাবেই। প্রযুক্তির সংগঠন সিটিআইন জানিয়েছেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের অর্থ এই নয় যে, মোবাইল ফোন- ক্যান্সারের কারণ আর এর পেছনে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণও নেই।তবে মোবাইলের বিকিরণের বিষয়ে পূর্বে থেকেই হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন এবং তারা তাদের হ্যান্ডসেটগুলোর সাথে সংক্রান্ত সতর্কবার্তাও প্রদান করে আসছে আগে থেকেই। যেমন টেক জায়ান্ট আইফোন এর সতর্কতা অংশে বলা আছে।ভয়েস কল বা তারবিহীন যে কোনো মাধ্যমে তথ্য স্থানন্তরের সময় আইফোনকে শরীর থেকে ১৫ মিলিমিটার দূরত্বে রাখুন।একইভাবে আর ব্ল্যাকবেরী সেটগুলোর ক্ষেত্রেও যে কোনো ধরনের তথ্য স্থানান্তরের সময় ব্যবহারকারীদের শরীর থেকে ২৫ মিলিমিটার দূরত্বে সেট রাখতে বলা হয়েছে। শরীর থেকে দূরে রাখলে সেট থেকে নির্গত বিকিরণ শরীরে পৌঁছানোর মত শক্তি রাখে না বলেই ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে
মোবাইল ব্যবহারের সতর্কতা
স্বাস্থ সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের পর স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষদের মধ্যে কাজ করছে নেতিবাচক মনোভাব। তবে তাদের আশস্ত করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। সাধারণভাবে মোবাইল ব্যবহারের জন্য কিছু সতর্কতার কথাও তারা উল্লেখ করেছে। এসব সতর্কতার মধ্যে রয়েছে
- হেডসেট ব্যবহার যাতে মোবাইল ফোন যথাসম্ভব দূরে রাখা যায় শরীর থেকে
- কথা বলার চেয়ে এসএমএস বেশি বেশি ব্যবহার করা
- সবসময় ফোন চালু না রাখা
- মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ কম থাকলে বিকিরণ বেশি হয়। তাই সবময় ব্যাটারির চার্জ নিশ্চিত রাখা
-শিশুদের মোবাইল ব্যবহার না করতে দেয়া